ব্লাড ক্যান্সার (Blood cancer)
হোমিও চিকিৎসায় ক্যানসার আরোগ্য
ডাঃ অরবিন্দ সরকার
হজকিন্স ডিজিজ (Hodgkin’s disease) :- ১৮৩২ খ্রীঃ টমাস হজকিন প্রথম এই অদ্ভুত রোগটির বর্ননাদেন এবং তার নাম অনুসারেই রোগটার নাম হজকিন্স ডিজিজ্ । এটি সত্যই দুষ্ট স্ফীতি কিনা এ নিয়ে তর্কবিতর্ক ছিল। কেউ কেউ বলতো টিউবার কুলোসিস বা যক্ষা। কোন কোন কর্মীর বিশ্বাস ছিল ভাইরাস সংক্রমনের ফলে সৃষ্ট গ্রানুলোসা বা কনিকা কার স্ফীতি। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন এটা প্রাথমিক ভাবে থাইমাস গ্লান্ডের টিউমার যা পরে বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু দুষ্ট স্ফীতির সাথে এর কতগুল অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে, টিউমার এর মতোই বেড়ে উঠে, আক্রমনাত্মক অভিযান চালায়, ছড়িয়ে যায় দেহের বিভিন্ন যন্ত্রে এবং চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অবধারিত। এই সব বৈশিষ্ঠ বিচার করে আধুনিক কর্মীগণ এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে এটা প্রাথমিকভাবে দুই স্ফীতি ছাড়া কিছুই নয়। এটি লসিকা কলার বৃদ্ধিশীল প্রাণঘাতী একটা অসুখ, যাতে লসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলেউঠে, প্রথমে স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ থাকে পরে সাধারণ ভাবে সারা দেহে ছড়িয়ে যায় ।
রোগ লক্ষণ ঃ- রোগটি সুক্ষভাবে অগ্রসর হয়, প্রায় ক্ষেত্রে লসিকা গ্রন্থি গুলি বড় হয়ে উঠে। সাধারণতঃ অন্যকোন লক্ষণ এ সময় থাকেনা । হঠাৎ লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি নজরে আসে- কাশি, সর্দি বা ফুসফুসের সাধারণ কোন সংক্রামনের পর। বগল ও কুচকির গ্লাভ বড় হয়। তার পর জ্বর হয়। ওজন কমতে থাকে, দুর্বলতা বোধ করে। জ্বর প্রায় সর্বদা থাকে, রাত্রে ঘাম হয়। কখনও বা নির্দিষ্ট ছকে জ্বর আসে ৪ থেকে ১৫দিন থাকে। তার পর কিছুদিন জ্বর থাকেনা আবার জ্বর হয়। এই প্রকার জ্বরকে পেল এবস্টেইন(Pel-Ebstein) বলে। স্বাস নিতে, গিলতে কষ্ট হয়। লসিকা গ্রন্থি গুলি বড় হয়ে বিভিন্ন স্থানে চাপের সৃষ্টিকরে ফলে পেটে জল জমতে পারে। দুটো পায়ের নিচের দিকে ফুলে যেতে পারে। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে পক্ষঘাত হতে পারে। শরীর দারুন দুর্বল ও কৃশ হয়ে যায়, রক্তাল্পতা দেখা দেয়। প্লীহা ৪/৬ আঙ্গুল বাড়ে, যকৃতও বাড়ে। মদ খেলে গ্রন্থিগুলি প্রচন্ড ব্যাথা হয় । মদ সহ্য হয়না। শেষ অবস্থায় টিউমার সর্বত্র ছড়িয়ে যায়, ফুস ফুস, যকৃত, হাড় মজ্জা স্নায়ুতন্ত্র, চর্মে, প্রভৃতিতে। হজকিন্স ও লিউকিমিয়া যুগপৎ আক্রমন খুব কমই দেখা যায়। যুগপৎ আক্রমন হলে ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকিমিয়া বা মায়ালো সাইটিক লিউকিমিয়া হয়। রোগ নির্ণয়ের জন্য বায়ন্সী করা দরকার। বায়ন্সী করলে অনুবিক্ষণ যন্ত্রের পরীক্ষান্তে স্টানবার্গ রীড কোষ দেখা যায় ।
লিউকিমিয়া (Leu kaemia) :- লিউকিমিয়া অর্থ সাদা রক্ত। এ রোগটা যদিও আজ সকলের পরিচিত তাহলেও রোগটাকে যথার্থভাবে চিনতে পারা গেছে মাত্র ১৫০ বছর আগে। প্রথম বর্ননা দেন ডাঃ ভেলপিউ ১৮২৭ খ্রীঃ। তার রোগী ছিল ৬৩ বছরের লেমনেড বিক্রেতা, তার প্লীহা ও লিভার অস্বাভাবিক বড় হয়ে যায়। মারা যাবার পর প্লীহার ওজন হয় ১০ পাউন্ড। রক্ত হয়ে গিয়েছিল দই এর মন্ড বা লপসির মত গাঢ়। বেনেট ১৮৪৫ খ্রীঃ স্কটল্যান্ড ও ভিরশাও ঐ একই বছরে রোগটার নামকরন করেন লিউকিমিয়া। রোগটাকে লিউকোসিসও বলে।
সংজ্ঞা :- রক্ত কোষ সৃষ্টিকারী কলায় যে কোন ধরনের কনিকার সাধারণভাবে সংখ্যায় অস্বাভিক বৃদ্ধি পাওয়া, নিজে নিজেই পরিব্যাপ্ত হওয়া, এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে রক্তে আবির্ভূত হয় পুঞ্জ পূঞ্জ স্বেত কনিকা, তাদের পরিমানগত ও গুনগত পরিবর্তন ঘটে, রক্তাল্পতা দেখা দেয়, অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যায় ফলে থ্রম্বো সাইটোপিনিয়া হয়, পরিনামে মৃত। রক্ত কোষ গঠিত হয়- মুলতঃ রক্তমন্ড, লোহিত ও শ্বেত কনিকা এবং অনুচক্রিকা দিয়ে। লিউকিমিয়াতে রক্তের শ্বেত কনিকার গননা বেড়ে যায়। কিন্তু অস্বাভাবিকতা যা, সেটা সত্যি সত্যি রক্তের নয় মূখ্যত যে কলাগুলি রক্ত কোষ তৈরী করে তাদের এবং গৌণতঃ অন্য বহুবিধ কলার যেখানে শ্বেত কনিকারা আশ্রয় নেয় এবং জড়ো হয়। কাজেই রক্তে গুরত্ব লিউকিমিয়াতে গৌণ। শুধু যাতায়াতের পথ হিসাবে রক্ত প্রবাহ কাজ করে। যে যন্ত্র সমূহে রক্ত তৈরী হয়, তাদের সেই জন্মস্থান থেকে রক্ত স্রোতের মাধ্যমে শরীরের অন্য সমস্ত কলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। শ্বেত কনিকার সংখ্যা বৃদ্ধি কোন কোন ক্ষেত্রে নাও হতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ অপেক্ষা অনেক কম হয়। কিন্তু শ্বেত কনিকার মূল ত্রুটি এই যে সে স্বাভাবিক ভাবে পূর্নতা প্রাপ্ত হয় না। মজা এই যতদিন পর্যন্ত কোষ গুলি পূর্ণ বর্ধিত না হয় তত দিন তারা সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই এই বৃদ্ধির হার যত কমই হউক তাদের আয়ুষ্কাল অনেক বেড়ে যায় যেন তারা অমর হয়ে যায়।
ব্লাড ক্যান্সারের কারণ :- ব্লাড ক্যান্সারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো কেমিক্যাল। এরপর ভাইরাস, পরিবেশগত রেডিয়েশন। আর আগেই বলেছি জেনেটিক কারণ। তবে এর সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি, নানা গবেষনা নানা কারণ দেখিয়েছেন যথা-
(১) অনেকে বলেন এটা জীবানু বা ভাইরাস ঘটিত সংক্রামন, লিউকিমিয়া কোষে এগুলো পাওয়া গেছে। পরে জানা গেছে এগুলো গৌণভাবে আক্রমন করেছে।
(২) একটি মতঃ- এটা বিপাকজনিত বা অভাব জনিত কোন অসুখ। অসুখ হবার পর রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়া হয় তাতে ভাল থাকে এই থেকে, এই মতবাদের সৃষ্টি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এটা অভাব জনিত অসুখ বলে প্রমাণিত হয়নি।
(৩) অনেকে বলেন (ক) রক্তের মধ্যে গ্রানুলোসাইট শ্বেত কনিকাগুলি হঠাৎ খুব বেশী পরিমানে ধ্বংস হয়, এর ক্ষতিপূরন হিসাবে পরক্ষনেই টিউমারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে ।
(খ) শ্বেত কনিকা গুলির স্বাভাবিক ধ্বংস প্রক্রিয়া বা তাদের নিস্কাশন ত্রুটিপূর্ণ ।
(গ) কোন কঠিন চাপ বা নিয়ামক প্রভাবের ফল। এই সব তত্ত্ব দিয়ে কিন্তু পরিপূর্ণ রোগটির গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় নি।
(৪) এমনও বলা হয়েছে কোন কোন মানসিক বিশৃঙ্খলা লিউকিমিয়া সৃষ্টি করে, এই ব্যাখ্যাও স্পষ্ট নয়। যাই হোক লিউকিমিয়া সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ও সুপ্রমানিত একটি তথ্য এখনও জানা যায়নি। কতগুলি রাসায়নিক বস্তু লিউকিমিয়া করে বলে জানা গেছে আর্সেনিক, বেঞ্জিন, সালফোনামাইড, কোন কোন ঔষধ, ক্লোরাম ফেনিকল। গাটের ব্যাথা কমাবার ঔষধ ফিনাইল বিউটাজোন এবং ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুইটি ঔষধ Thiotepa এবং Chlorumbucil লিউকিমিয়া সৃষ্টি করতে পারে। পারমানবিক বিকিরণ লিউকিমিয়া সৃষ্টি করতে পারে এ রকম প্রমাণ বিদ্যমান। লিউকিমিয়া বংশগত কিনা এ বিষয়ে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই।
ব্লাড ক্যান্সারের উপসর্গ :-
(ক) স্থায়ী ক্লান্তি ও দুর্বলতা।
(খ) খিদে না পাওয়া, বমি বমি ভাব।
(গ) অপ্রত্যাশিত রকমের ওজন কমে যাওয়া।
(ঘ) রাতে ঘামা।
(ঙ) হাড় ও সন্ধিস্থলে ব্যাথা।
(চ) তলপেটে অস্বস্তি।
(ছ) মাথাব্যথা।
(জ) শ্বাসকষ্ট।
(ঝ) বার বার সংক্রমণ।
(ঞ) খসখসে চামড়া ও ফুসকুড়ি।
(ট) গলা, বগল ও কুঁচকির লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া।
ব্লাড ক্যানসারের শ্রেণী বিভাগ :- লিউকিমিয়াও অনেক ধরণের হয়, তাদের প্রত্যেকের লক্ষণ ও চিহ্ন আলাদা, কোন কোন লিউকিমিয়া খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু ডেকে আনে। আবার কোনো ধরনের রোগে মানুষ বেশ কিছুদিন বাঁচতে পারে।
রক্তের শ্বেত কণিকা তিন ধরনের- (১) গ্রানুলোসাইটিক (Granulocytic)
(২) লিম্ফোসাইটিক (Lymphocytic)
(৩) মনোসাইটিক (Monocytic) ।
মজ্জার আদি সায়ানোব্লাস্ট কনিকা থেকে তৈরী হয় গ্রাণুলোসাইট; আদি লিম্ফোব্লাস্ট থেকে তৈরী হয় লিম্ফোসাইট । মনোব্লাস্ট থেকে তৈরী মনোসাইট। কখনও কখনও প্লাসমা কোস (Plasma cell); হিস্টিওসাইট (Histiocyte) ও মাস্ট কোস (Mast cell) ও রক্তে পাওয়া যায় ।
এটা মনে রাখলে লিউকিমিয়ার শ্রেণী বিভাগও মনে রাখা যাবে। মোটামুটি বিষম (Acute) লিউকিমিয়া, দীর্ঘস্থায়ী লিম্ফ্যাটিক লিউকিমিয়া ও দীর্ঘস্থায়ী গ্রানুলোসাইটিক লিউকিমিয়া এই তিন ধরনের রোগের লক্ষণ ও চিহ্ন আলোচনা করা হলো।
ব্লাড ক্যান্সারে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা :
মেরুমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা যায় কিন্তু তাা এত অত্যান্ত ব্যয়বহুল। সবাই করতেও পারে না আর পারলেও নিশ্চিত সফলতা লাভ হয় না হোমিওপ্যাথিতে ব্ল্যাড ক্যানসার রোগের চিকিৎসা রয়েছে। সার্বিক লক্ষণের বিশ্লেষণে যে ওষুধের সঙ্গে লক্ষণ মিলে যায় ঐ ওষুধ দিয়েই ব্লড ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা করতে হয়। হোমিওপ্যাথিতে প্রায় ৩৭টি ওষুধ আছে। তবে সাধারণত যে সব ওষুধ সাদৃশ্য লক্ষণের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হয় তা নিন্মে দেওয়া হলো –
(১) আর্সেনিক এলবাম (Arsenicum Album)।
(২) ক্যাডমিয়াম সাল্প (Cadmium Sulfate)।
(৩) রেডিয়াম ব্রোমাইড(Radium;bromide)।
(৪) সিয়ানোথাস আমেরিকানাস (Ceanothus Americanus)।
(৫) চিয়োন্যন্থাস (Chionanthus virginica)।
(৬) ফেরাম ফসফরিকাম (Ferrum Phosphoricum)।
(৭) ফেরাম মেটালিকাম (Ferrum Metallicum)।
(৮) ফেরাম-আইওড (Ferrum Iod)।
(৯) আর্নিকা আর্স-আইওড ((Arnica Arsenicum-lodatum)।
(১০) ক্যাল ফস ((Calcarea phos)।
(১১) ক্যাল কার্ব (Calcarea Carb)।
(১২) চায়না অফ (China off)।
(১২) ফেরাম পিকরিক (Picricum Trituration)।
(১৩) কালি ফসফোরিকাম (Picricum Trituration)।
(১৪) নেট্রাম অ্যাসিটিক (Natrum Acetic)।
(১৫) নেট্রাম মিউর (Natrum Mur)।
(১৬) নেট্রাম ফসফরিকাম (Natrum Phosphoricum)।
(১৭) পিক্রিকাম অ্যাসিডাম (Acidum Picricum)।
(১৮) এক্স-রে (X-Rays)।
(১৯) সালফার (Sulphur)।
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া মানবেদেহে ঘাতক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত। তাই এ রোগের উৎপত্তি, কারণ, উপসর্গ-প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সবারই ধারণা থাকা উচিত।
আরোগ্য হোমিও হল এডমিন : আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করলাম। আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন। নতুন কোনো স্বাস্থ্য টিপস নিয়ে হাজির হবো অন্য দিন। এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যগুলো কেবল স্বাস্থ্য সেবা সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণের জন্য। অনুগ্রহ করে রেজিষ্টার্ড হোমিওপ্যাথিক পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে আপনার শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হতে পারে। প্রয়োজনে, আমাদের সহযোগিতা নিন। এই ওয়েব সাইটটি কে কোন জেলা বা দেশ থেকে দেখছেন “লাইক – কমেন্ট” করে জানিয়ে দিন। যদি ভালো লাগে তবে “শেয়ার” করে আপনার বন্ধুদের জানিয়ে দিন। সবাই সুস্থ্য, সুন্দর ও ভালো থাকুন। নিজের প্রতি যত্নবান হউন এবং সাবধানে থাকুন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।